গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব ইয়াও ওয়েন
২০২৪ সালের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী। বিশেষ এ মুহূর্তে, বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে, চীনের উন্নয়ন এবং চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বে যারা বছরের পর বছর অবদান রেখেছেন তাঁদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও গভীর শ্রদ্ধা। একইসাথে, বাংলাদেশে বসবাসরত চীনের সকল নাগরিকদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক অভিনন্দন। বিগত ৭৫ বছরে, চীনের জনগণ অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর সাফল্যের ইতিহাস রচনা করেছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, জাতি হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে চীনের উত্থান হয়েছে, সেখান থেকে সমৃদ্ধির দিকে যাত্রা করে চীন শক্তিশালী এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। চীনের জনগণ সফলভাবে চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সমাজতন্ত্রের এক সুউজ্জ্বল পথ তৈরি করেছে। চীন সকল প্রেক্ষিতেই প্রথম শতবার্ষিক লক্ষ্য অর্জন করেছে-যা হলো একটি পরিমিত সমৃদ্ধ সমাজ গঠন। এখন চীন তার দ্বিতীয় শতবার্ষিক লক্ষ্য অর্থাৎ একটি আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হওয়ার পথে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে চলেছে।
বিগত ৭৫ বছরে, চীন বিশ্বের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বর্তমানে, মানবজাতি ঐক্য ও সহযোগিতা বা বিভাজন ও সংঘর্ষ, কিংবা পারস্পরিক লাভ বা একপক্ষের অর্জন এবং সাধারণ নিরাপত্তা বা অশান্তি ও যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। এ অবস্থায়, চীন সকল অংশীজনদের সাথে একসাথে কাজ করতে প্রস্তুত: যেনো সবার জন্য একটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নির্মল ও সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলা যায়, যেখানে থাকবে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, সার্বজনীন নিরাপত্তা এবং সাধারণ সমৃদ্ধি। চীন বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ এবং বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগ বাস্তবায়নে, মানবজাতির জন্য সমন্বিত ভবিষ্যতের এক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠায় এবং সবার জন্য মানবতার বিশ্ব গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের দশকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, চীনের অর্থনীতি ৬.১ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে মধ্য থেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গড়ে ৩০ শতাংশেরও বেশি অবদান রেখেছে। এ বছর চীনের জিডিপি বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থিতিশীল, সুষ্ঠু এবং উর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে। চীনের উন্নয়ন বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের জন্য উন্নয়নের আরও সুযোগ সৃষ্টি করবে। এই বছরের জুলাই মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের তৃতীয় প্লেনারি অধিবেশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। নতুন যুগে সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা ।ও জাতীয় পুনরুজ্জীবনের অগ্রগতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এ অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ অধিবেশনে সংস্কারকে আরও গভীরভাবে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা চীনের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা এবং রূপরেখা তৈরি করেছে।
আমরা চীনা-শৈলীর ভিত্তিতে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে চীনা জাতির মহান পুনরুজ্জীবন অর্জনে অটল থাকবো এবং মানবজাতির জন্য সমন্বিত এক সম্প্রদায় গঠনের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচার ভবিষ্যতের চালিয়ে যাব। আমরা চীনের উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বকে নতুন সুযোগ প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি এবং চীন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন এবং মানবজাতির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছে। চীন ও বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী ও ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ সম্মান এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ৫টি নীতির ওপর ভিত্তি করে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা বিশ্বাস করি, কেবল বাংলাদেশের মানুষেরই অধিকার রয়েছে তাদের উন্নয়নের পথ কী হবে তা বাছাই করার। আমরা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি উত্তম প্রতিবেশীসুলভ আচরণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ নীতি অনুসরণ করি। বাংলাদেশও এক-চীন নীতিতে ড়ভাবে সমর্থন ব্যক্ত করে। তাইওয়ানকে চীনা ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে স্বীকৃতি দেয় এবং হংকং, শিনচিয়াং, শিচাং ও মানবাধিকারের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে চীনকে অব্যাহতভাবে সমর্থন জানায়। বাংলাদেশের ভেতর যেরকম পরিবর্তনই আসুক না কেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে চীনা প্রতিশ্রুতি সবসময় একই রকম থাকবে। চীন সম্পূর্ণভাবে নিশ্চি নিশ্চিত যে আমাদের সহযোগিতা সবসময়ই কার্যকর ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বিকাশে ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ এর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ব্যাখা, অর্থনৈতিক উন্নয়নে উন্নয়নের বিকাশ ও মানুষের জীবনমান উন্নত করতে সক্ষম হবে বলে আন্তরিকভাবে আশা করে চীন। বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তার জন্য, চীন বাংলাদেশকে ১০০% করযোগ্য আইটেমের উপর শূন্য-শুল্ক প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার অর্থ চীন এবছর ডিসেম্বর ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশের খাদ্যশস্য, চিনি, ভোজ্য তেল, রাবার এবং রাবার পণ্য, কাঠের পণ্য, পাট এবং পাট পণ্য, কাগজ এবং কাগজের পণ্য, পশম এবং তুলা আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। স্থানীয় কৃষকদের সুবিধার্থে বাংলাদেশের আম আমদানি করবে চীন। বন্যা মোকাবিলায় চীন। বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৪ লাখ মার্কিন ডলার। সমমূল্যের উদ্ধার সরঞ্জাম প্রদান করেছে চীন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর, গত দেড় মাসে চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডলার বিনিয়োগ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ ও আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ক্ষেত্রে চীনের আস্থার দিকটিই প্রতিফলিত হয়। তার ওপর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুরোধে, গত জুলাই ও আগস্ট আন্দোলনে আহত রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তা দিতে চীন তার ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব দুই দেশের মানুষের জন্যই দৃশ্যমান সুবিধা নিশ্চিত করেছে। কেন্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় বাংলাদেশে, ৭ টি রেলপথ, ১২টি মহাসড়ক, ২১টি সেতু ও ৩১টি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প নির্মাণ করেছে চীন, যেখানে সাড়ে ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সরাসরি বিমান যোগাযোগের মাধ্যমে দুই দেশের রাজধানীকে সংযুক্ত করায় দু'দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও পারস্পরিক যোগাযোগের মাত্রা আরও গভীর হয়েছে। যেখানে প্রতি সপ্তাহে মোট ৮০টি ফ্লাইট প্রায় ১৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করছে। বাংলাদেশের প্রায় ২০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী চীনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। বিগত বছরগুলোতে ২টি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট ও ১টি কনফুসিয়াস ক্লাসরুম বাংলাদেশের প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণে ভূমিকা রেখেছে। আগামী বছর, বাংলাদেশ ও চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক নতুন ঐতিহাসিক পর্যায়ে উন্নীত করবে। বাংলাদেশের সাথে নিবিড়ভাবে কাজের সুযোগ পেতে, দুই জাতির মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব আরও জোরদার করতে, বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সুবিধাজনক সহযোগিতা ও লেনদেন লেনদেন আরও গভীর করতে এবং একসাথে মানসম্পন্ন বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতা নিশ্চিত করতে আগ্রহী চীন: এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীনের ব্যাপক কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আগামী বছর চীন ও বাংলাদেশের মানুষে-মানুষে আদানপ্রদানেরও বছর ('চীন-বাংলাদেশ ইয়ার অব পিপল-টু-পিপল এক্সচেঞ্জেস')। আমরা রাজনৈতিক আদানপ্রদান, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, পর্যটন, ক্রীড়া, জনস্বাস্থ্য, তরুন-যুবা, নারী, মিডিয়া ও অ্যাকাডেমিক যোগাযোগের মতো বিভিন্ন খাতে বেশকিছু কার্যক্রম নিয়ে আসছি। এ সকল উদযাপনের লক্ষ্য আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন, যেন আমাদের দুই দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের জন্য আরও বেশি সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। তরুণরা সমৃদ্ধ হলেই একটি জাতি উন্নত হয়। তরুণরাই স্বপ্নে পরিপূর্ণ আর সবচেয়ে উদ্যমী। আশা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্ব হয়ে উঠছে তরুণরাই। স্বপ্নপূরণের প্রতিশ্রুতিশীল সম্ভাবনায় ভরপুর এমন একটি বিশেষ সময়ে বাস করছে তারা। আমি আশা করি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই বন্ধুত্বের দীপ্ত মশাল পৌঁছে দিতে তরুণরা চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতায় নিজেদের নিয়োজিত করবে।
চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।